সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ছিলেন 'রসায়ন' বিজ্ঞানের ছাত্র। শিক্ষকতা দিয়ে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন - সরকারী চাকরিও করেছিলেন বেশ কিছু কাল। বিখ্যাত এক রাসায়নিক প্রতিষ্ঠানে অ্যানালিষ্টের চাকরিতে কর্মরত থাকা অবস্থায়, তিনি তাঁর জীবনের প্রথম হাসির গল্পটি লেখেন। রঙ্গ-ব্যঙ্গের লেখার মধ্যে মূল্যবোধ ও মানবিকতার অদ্ভুত মিশেল লক্ষ্য করা যেতো তাঁর গল্পগুলির মধ্যে। বিশেষ করে বাঙালি যৌথ-পরিবারের নিজস্ব দোষ-ত্রুটি-চাহিদার মধ্যে ফল্গুধারার মতো লুকিয়ে থাকা স্নেহ-ভালবাসা-শ্রদ্ধার মুহূর্তগুলিকে অসাধারণ মুন্সীয়ানায় তিনি তুলে ধরেছিলেন পাঠকদের কাছে।
সেই সুদূর ছোটবেলায় খুব সম্ভবত 'রুকু-সুকু'-র গল্প দিয়েই তাঁর লেখার সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিলো। আজন্ম যৌথ-পরিবারে মানুষ হয়ে ওঠা আমার বাড়ির চেনা-জানা চরিত্রগুলোকেই যেন আমি বারবার করে খুঁজে পেতাম তাঁর লেখা বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস গুলির মধ্যে। তাই সেই গল্পগুলিকে আমার কখনোই গল্প বলে মনে হতো না - বরং মনে হতো আমার নিজেদের বাড়িরই কোনো এক সময়ের ঘটনা - ঠিক যেন অনেকটা 'প্যারালাল ইউনিভার্স'-এর কনসেপ্ট !!
হাসির গল্প অনেকেই লিখেছেন, লিখে চলেছেন, আর লিখবেনও - কিন্তু সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখার মতো এমন 'হাসি-হিউমার, ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-সুখের টানাপোড়ন ও শ্বাশত জীবনবোধে ভরপুর কথা-সাহিত্য যে ভবিষ্যতে আদৌ পাওয়া যাবে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।
|
প্রথম সংস্করণ: সেপ্টেম্বর, 1979 |
এই পোস্টে আমি তুলে ধরলাম আজ থেকে প্রায় ৩৬ বছর আগেকার এক হাসির গল্প, 'সোফা-কাম-বেড'। এই গল্পবইটি আমি খুব সম্ভবত: ঢাকুরিয়ার কাছে গোলপার্কের একটি পুরানো বইয়ের দোকান থেকে নাম মাত্র মূল্যে কিনেছিলাম। এটিতে সোফা-কাম-বেড ছাড়াও আরও ১১টি ছোট গল্প আছে, তবে শুধুমাত্র 'সোফা-কাম-বেড' গল্পটির জন্যেই আমি এই বইটি কিনেছিলাম। যখন আমি ক্লাস এইটে বা নাইনে পড়ি, তখন আমাদের বাড়িতে আমার মেজদা চাকরি পাবার কিছু পরে দুটি রেডিমেড সোফা কিনে আনেন। সাদামাটা, রেক্সিনের কভারে মোড়া দুটি বেশ লম্বা সোফা - পিছনের স্ট্যান্ডটা খুলে দিলেই হেলান দেবার অংশটি সোজা হয়ে গিয়ে দিব্যি চওড়া শোবার জায়গা হয়ে যায়। তবে আজকালকার দিনের দামি সোফা-কাম-বেড-এর পাশে সেই সেদিনকার সাধারণ 'সোফা-কাম-বেড' দুটিকে রাখলে, তাদের আজ বড়োই করুণ ও মলিন দেখাবে। কিন্তু সেই সোফা-সেট দুটি বাড়ির কোন কোন জায়গায় রাখা হবে, তা নিয়ে আমাদের পরিবারে শুরু হযে যায় কি দারুণ উত্তেজনা, আর সেই সাথে একটু মন-কষাকষির ভাব - ঠিক সেই গল্পের 'সোফা-কাম-বেড'-এর চরিত্রগুলির মতো করেই। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমরা দৌড়ে এসে সোফায় বসে পড়তাম - পারলে দিনের যাবতীয় কাজকর্মই যেন সেই সোফায় বসে সেরে ফেলবার চেষ্টা করতাম !! কিছুদিন পরেই সেই সোফা-দুটির জন্যে পাড়ার দর্জিকে ডেকে নিয়ে এসে স্পেশাল দুটো কভারও বানানো হয়। যথারীতি সেই কভারের রং-ডিজাইন পছন্দ করা নিয়েও আবার কি বিষম বিপত্তি শুয়ে হয়ে যায় !!
'সোফা-কাম-বেড' গল্পটি সেই সময় অ্যাতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিলো যে 'আকাশবাণী' থেকে এই গল্পটির একটি শ্রুতিনাটক তৈরী করে তা খন্ডে খন্ডে প্রচার করা হয়েছিলো। তরুণ বন্দোপাধ্যায়, মমতাশংকর, রমাপ্রসাদ বণিক সহ তখনকার দিনের বেশ কিছু জনপ্রিয় ও বিখ্যাত অভিনেতারা এই শ্রুতি-নাটকটিতে অংশ নিয়েছিলেন। বেশ কিছুকাল পরে সেই শ্রুতি-নাটকটি ক্যাসেট হিসাবেও বার হয়, খুব সম্ভবত: 'HMV', বা 'ইনরেকো', কিম্বা 'রাগিণী' রেকর্ডিং কোম্পানি থেকে, আজ আর ঠিক মনে পড়ছেনা। আমার ছোটদা একসময়ে সেই ক্যাসেটটি কিনে এনেছিলেন। আমরা সবাই মিলে একসাথে বসে কারণে-অকারণে কতোবার যে সেই নাটকটি আমাদের সেই আদ্যিকালের টেপ-রেকর্ডারে শুনেছিলাম, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। স্রেফ সেই নাটকটা শোনার জন্যে আত্মীয়স্বজন থেকে পাড়ার কতো লোক আমাদের বাড়িতে আসতেন সেই সময়ে...
* * * * * *
আজ আমাদের বাড়িতে সেই সোফা-সেট দুটি এবং সেই সোফাদুটিতে বসে থাকা চরিত্রগুলির মধ্যে অনেকেই আর নেই আমার সাথে। যাঁরা এখনো বা টিকে আছেন তাঁদের সাথেও আর সেই আগেকার দিনের মতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আর নেই। শুধু সঙ্গে আছে সেই পুরানো শতছিন্ন 'সোফা-কাম-বেড' গল্পবইটি, আর সেই শ্রুতিনাটক ক্যাসেটটির ডিজিট্যালাইজড MP3 - সেই দুটিকেই মাঝে-মধ্যে রি-ওয়াইন্ড করে পড়ি, আর শুনে চলি - আর এইভাবেই চোখ বন্ধ করে সেই হারিয়ে যাওয়া সোনালী দিনগুলোকে, সেই হারিয়ে যাওয়া অতিপ্রিয় মানুষগুলিকে একটু একটু করে ছুঁয়ে ধরার বৃথা চেষ্টা করি. . .